‘প্রতীক্ষার’ জেদ! বিধবা সাফাইকর্মী(sweeper) থেকে আজ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের (SBI) ম্যানেজার এই মহিলা

মহানগর বার্তা ওয়েবডেস্কঃ ২০ বছর বয়সে বিধবা হয়ে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে আকুল পাথারে পড়েছিলেন এই মা। ছেলের মুখে দুটো খাবার তুলে দেওয়ার জন্য সাফাই কর্মীর (Sweeper) কাজ শুরু করেন। এক প্যাকেট বিস্কুট কেনার জন্য যাঁকে দুটো স্টপেজ আগে বাস থেকে নেমে পড়তে হতো, সেই মা’ই আজ সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে, সাফাইকর্মী থেকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (SBI) অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার!
গল্প মনে হচ্ছে? কিন্তু প্রতীক্ষা তোন্ডওয়ালকরের জীবন কাহিনী এমনই। যা যেকোনও হেরে যাওয়া মানুষকে আবার লড়াইয়ের স্বপ্ন দেখাতে পারে। ‘আমিও পারি’ এই বিশ্বাসটা বহু মানুষের মধ্যে বুনে দিতে পেরেছেন এসবিআইয়ের (SBI) রিজিওনাল এজিএম প্রতীক্ষা।

১৯৬৪ সালে পুনের এক পিছিয়ে দরিদ্র পরিবারে জন্ম প্রতীক্ষা তোন্ডওয়ালকরের। দশম শ্রেণির পরীক্ষা দেওয়ার আগেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে সদাশিব কাদুর সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। ফলে পড়াশোনায় ওখানেই ইতি টানতে হয় প্রতীক্ষাকে। স্বামী সদাশির মুম্বাইয়ের একটি এসবিআই (SBI) শাখায় বুক বাইন্ডারের কাজ করতেন। সেইসময় কম্পিউটার ছিল না, ফলে ব্যাঙ্কের হিসেবের খাতা প্রতি দিন যত্ন করে বাঁধিয়ে রাখতে হত। এই কাজটা করতেন বুক বাইন্ডাররা। প্রতীক্ষার স্বামী সদাশিবও তাই করতেন। তাতে যে খুব ভালো বেতন পেতেন তা নয়, তবে দুজনের চলে যেত।
এদিকে বিয়ের মাত্র এক বছর পরই প্রথম সন্তানের জন্ম দেন প্রতীক্ষা! তখনও তাঁর বয়স ১৮ পেরোয়নি। এর বছর তিনেক পর মুম্বাইয়ের কর্মক্ষেত্র থেকে পুনের গ্রামের বাড়িতে আসার সময় পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় সদাশিবের! ফলে মাত্র ২০ বছর বয়সে বিধবা হয়ে যান প্রতীক্ষা। বছর তিনেকের ছেলেকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। স্বামীও তেমন কিছু রেখে যেতে পারেননি। ফলে, কী খাবেন, কী করে ছেলেকে বড় করবেন সেই চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত মুম্বাইয়ে এসবিআই-এর (SBI) যে শাখায় সদাশিব কাজ করতেন সেখানে গিয়ে হাজির হন এই তরুণী মা। অনুরোধ করেন, তাঁর কোনও একটা কাজের ব্যবস্থা যেন করে দেওয়া হয়। যাতে সন্তানকে তিনি বড় করে তুলতে পারেন। এদিকে দশম শ্রেণিও পাশ না করায় প্রতীক্ষাকে খুব একটা ভালো কোনও কাজ দেওয়ার সুযোগও ছিল না ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের। শেষ পর্যন্ত তাঁকে বলা হয়, চাইলে তিনি সাফাই কর্মীর কাজ করতে পারেন। কারণ ওই শিক্ষাগত যোগ্যতায় এটাই একমাত্র সম্ভব!
সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত সাফাই কর্মী হিসেবেই স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (SBI) ওই শাখায় কাজ শুরু করেন প্রতীক্ষা। রোজ ব্যাংকের মেঝে ঝাড়-পোঁচের পাশাপাশি শৌচালয় পরিষ্কার করতে হতো। সেই সঙ্গে যাবতীয় আসবাবপত্র নিয়মিত সাফসুতরো করতেন। তার বিনিময়ে মাসের শেষে পেতেন মাত্র ৬০ থেকে ৬৫ টাকা! এই কটা টাকায় মুম্বাই শহরে থেকে সংসার চালানো অসম্ভব।
তাই এসবিআই-এর (SBI) সাফাই কর্মীর পাশাপাশি বাইরে আরও দু-একটা এমন কাজ হাতে নেন। ছেলেটাকে বড় করে তুলতে হবে তো। তখন অবস্থা এমনই ছিল যে ছেলে বিনায়ক বিস্কুট খেতে চাইলে পরের দিন অফিসে যাওয়ার সময় বাস থেকে আগের স্টপেজে নেমে পড়তেন, কারণ তাতে ভাড়া কম পড়ত। সেই টাকাটা বাঁচিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ছেলের জন্য কিনে আনতেন বিস্কুটের ছোট্ট একটা প্যাকেট!
কিন্তু প্রতীক্ষা বুঝেছিলেন এইভাবে হবে না। সন্তানকে ভালো করে মানুষ করতে হলে তাঁকে আরও ভালো কোনও কাজ পেতে হবে। তাঁর লক্ষ্য ছিল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (SBI) ক্লার্কের কাজ পাওয়া। তার জন্য সবার আগে পড়াশোনা করাটা জরুরি। তাই আত্মীয়-স্বজন ও সহকর্মীদের সহযোগিতায় আগে দশম শ্রেণি পাশ করেন। কিন্তু এসবিআই-এর ক্লার্ক হতে গেলে দ্বাদশ শ্রেণি পাস করতে হবে। তাই ভিখরোলের একটা নাইট কলেজে ভর্তি হন।
পরিচিতরা বই পত্র কিনে দিয়ে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। সাফাই কর্মীর হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বাড়ি ফিরেও প্রতিদিন মন দিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করেন। তার ফলও পান হাতেনাতে। ভালোভাবেই দ্বাদশ শ্রেণী পাস করে যান। ১৯৯৫ সালে সাইকোলজিতে মেজর নিয়ে অন্য আরেকটি নাইট কলেজে ভর্তি হন। এবার প্রতীক্ষার লক্ষ্য স্নাতক হওয়া। এরই মধ্যে তাঁকে ক্লার্ক পদে নিযুক্ত করে এসবিআই (SBI)।
অবশ্য এর বছর দুয়েক আগে প্রতীক্ষার জীবনে এসেছে বড় পরিবর্তন। ১৯৯৩ সালে ফের বিয়ে করেন তিনি। দ্বিতীয় স্বামী প্রমোদ তোন্ডওয়ালকর ছিলেন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (SBI) একজন পিওন। তবে সন্তানকে বড় করার জন্য প্রতীক্ষার লড়াই ও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে সবসময়ই উৎসাহ দিতেন প্রমোদ। প্রতীক্ষা যাতে নিজের স্বপ্ন সফল করতে পারেন তার জন্য বিয়ের পর থেকেই সংসার ও বিনায়ককে আগলে রাখতেন তিনি।
এরমধ্যে প্রতীক্ষা স্নাতকও হয়েছেন। স্টেট ব্যাঙ্কের ক্লার্ক হিসেবে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। ফলে ২০০৪ সালে তাঁকে অফিসার পোস্টে পদোন্নতি দেয় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। তিনি ট্রেইনি অফিসার নিযুক্ত হন। গত ১৮ বছর ধরে আরও পদোন্নতি হয়েছে তাঁর। তবে চলতি বছরের জুনে প্রতীক্ষা স্টেট ব্যাঙ্কের (SBI) এজিএম অর্থাৎ অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (Assistant General Manager) হয়েছেন! তাঁর এই কাহিনী ইতিমধ্যেই সর্বত্র ভাইরাল।
স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মুম্বাই রিজিওনালের এজিএম হিসেবে প্রতীক্ষা তোন্ডওয়ালকরের কাঁধে এখন গুরুদায়িত্ব। তাঁর আরও দু’বছর চাকরি আছে। ইতিমধ্যেই স্টেট ব্যাঙ্কে ৩৯ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। তবে একজন সামান্য সাফাই কর্মী থেকে স্টেট ব্যাঙ্কের এজিএম হয়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রতীক্ষা বুঝিয়েছেন চোখে স্বপ্ন থাকলে, মনে জোর থাকলে সফল হবেই! আগামী দিনে এভাবেই উঠে আসুন আরও আরও অনেক প্রতীক্ষা।।

