
“খিদে বাড়ে ঘরে ঘরে, অম্বানিরা পকেট ভরে… ”
বছর খানেক আগে কলকাতার রাজপথে একটি মিছিলে শোনা গিয়েছিল এমন শ্লোগান। তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতে প্রকাশিত হল বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তিদের নামের তালিকা। সেখানে ছয় নম্বরে জ্বলজ্বল করতে দেখা গেল দেশের ধনীতম শিল্পপতি মুকেশ আম্বানির নাম। এশিয়ার বিচারে একেবারে এক নম্বর! গর্বে বুক ফুলে উঠেছিল দেশবাসীর। চওড়া হয়েছিল ছাতি।
এর কয়েক মাস পরে প্রকাশ পায় আরো একটি আন্তর্জাতিক তালিকা। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক। এতে কিন্তু আর গর্বে বুক ফোলাতে পারে না একশো আটত্রিশ কোটি ভারতবাসী। কারণ ভারতের নাম এখানে ৯৪ তম স্থানে ঠাঁই পেয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ক্ষিদের জ্বালা মেটাতে পারে নি ভারত। পেটের জ্বালায় হাহাকার শুরু হয়েছে চারিদিকে। এবার যেন বুকে একটু কাঁটা বেঁধে। সে কাঁটা আরো খচখচ করে উঠে জানান দেয় ক্ষুধা নিবারণে ভারতের থেকেও ভালো অবস্থানে আছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, নেপাল।
বস্তুত, অনেক কাল আগে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজ শাসিত ভারতের বিবিধ অগ্রগতি দেখে বঙ্কিমচন্দ্র একবার প্রশ্ন করেছিলেন, “মঙ্গল কাহার?” দেশের হাজার হাজার দরিদ্র মানুষের কাছে দেশের শ্রীবৃদ্ধির কোনো আঁচ পৌঁছোচ্ছে কি? তাঁদের রোজকার জীবনে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি? প্রশ্ন করেছিলেন বঙ্কিম। ২০২০ সালের রোগ জর্জরিত ভারতের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির দিকে তাকালেও সেই কথাই মনে হয়। মুকেশ অম্বানির বিপুল সম্পত্তির কোনো আঁচ লাগে নি দেশের অধিকাংশ দীন দরিদ্র মানুষের গায়ে। তবে কি আম্বানি শ্রীবৃদ্ধিকে দেশের শ্রীবৃদ্ধি বলা চলে? একই দেশের মধ্যে ধনী দরিদ্রের এই বিভাজন কি কাম্য ছিল?
এ প্রসঙ্গে সিপিআইএমএল- এর রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষের কথায়, “একদিকে নিরন্ন ভারত, অন্যদিকে ফুলে ফেঁপে ওঠা কর্পোরেট হাউস, এই চিত্র যে কোনো পরিসংখ্যানের চেয়েও ভয়ানক।” অম্বানি আদানি প্রমূখ শিল্পপতিদের কাছ থেকে যদি বাধ্যতামূলকভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিয়ে গরীবদের মধ্যে বন্টন করার ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে হয়তো একই দেশের মধ্যে এমন তীব্র বৈষম্য চোখে পড়ত না। পার্থ বাবুর কথায়, ভারত যেন আবার ইংরেজ শাসনের লুঠের সাম্রাজ্যে ফিরে গেছে, দরিদ্রকে বঞ্চিত করাই যেখানে একমাত্র লক্ষ্য। আর এভাবে চললে সেই দিনটা খুব বেশি দূরে নেই যেদিন আবার ফিরে আসবে তেতাল্লিশের ভয়বহ মন্বন্তরের ছবি।
বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের মোকাবিলার জন্য এ দেশেও শুরু হয়েছিল লকডাউন। গত মার্চ মাস থেকে টানা প্রায় ৭ মাস লকডাউনে অচল হয়েছিল দেশ। জিডিপি ক্রমশ নিম্নগামী। কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন বহু সংখ্যক মানুষ। আনলক প্রক্রিয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চললেও করোনা সংক্রমণের হার খুব একটা কমে নি। এমতাবস্থায় বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের অবস্থান উদ্বিগ্ন করে তুলেছে বিশেষজ্ঞদেরও। সব মিলিয়ে দেশের বর্তমান অবস্থা দেখে বলতেই হয় সেই চিরকালীন পংক্তি, “এ জগতে হায় সেই বেশি ‘পায়’ আছে যার ভুরি ভুরি।”