এবারের থিমে পরিযায়ী শ্রমিকদের যন্ত্রণা, মানুষের হাহাকার তুলে ধরছে নাকতলা উদয়ন সংঘ

থিম পুজোতে কলকাতার অন্যতম বড়ো পুজো ক্লাবগুলোর মধ্যে অন্যতম নাকতলা উদয়ন সংঘ। এই দুর্গাপূজো কমিটির সঙ্গে যুক্ত আছেন রাজ্যের “হেভিওয়েট” মন্ত্রী তথা শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পার্থবাবু নাকতলা উদয়নের চেয়ারম্যান পদের দায়িত্বভার সামলাচ্ছেন। এই পুজো কমিটির আর এক প্রাণপুরুষ হলেন বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্ত। করোনা সংক্রমনের সময় কলকাতা পৌরসভার পৌর প্রতিনিধিদের ব্যস্ততা কয়েকগুণ বেড়ে গেলেও, সব সামলেও নাকতলা উদয়নের দূর্গোৎসবের যাবতীয় দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি। এবারের দূর্গোৎসবে রুপদানের দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন বিখ্যাত শিল্পী ভবতোষ সুতার।এবারের থিম এর নাম “বেকার মেঘেরা চলল দূর/ শরৎ আকাশে ব্যথার সুর।”
থিম নিয়ে বলতে গিয়ে শিল্পী ভবতোষ সুতার জানিয়েছেন “করোনা অতিমারীর কারণে চারিদিকে এই যে মৃত্যুর পদধ্বনি, পায়ে হেঁটে আসা পরিযায়ী শ্রমিকের হাহাকার, কাজ হারানো মানুষের জীবন যন্ত্রণা। অতিমারীর মধ্যে মানুষ যখন মৃত্যুর মুখোমুখি, তখনই সেই মৃত্যুর পাঁচিল ভেঙে যেন বয়ে যায় জীবনের তরঙ্গ। এই তরঙ্গ কখনো বয়ে আনে মঙ্গল ধ্বনি, আবার কখনো সে মেতে ওঠে আসুরিক উন্মত্ততায়। এই ভাবেই আবার শরৎকাল এলো। ভিন রাজ্য থেকে বাপের বাড়ি ফিরল মেয়ে। নতুন জীবনের আশা নিয়ে বাড়ী ফিরল পরিযায়ী শ্রমিক। জীবন এগিয়ে চলে। এই নিউ নর্মালে কোনও আড়ম্বর নয়, তরঙ্গায়িত জীবনের এক রূপকল্প আঁকার চেষ্টা করেছি আমরা।” এই কঠিন পরিস্থিতিতে নাকতলা উদয়ন কিন্তু সাধারণের মধ্যে জীবনে এগিয়ে চলার বার্তাই বুনে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের এবারের থিমের মধ্যে দিয়ে শিল্পীর ভাষায় “তরঙ্গ” ছড়িয়ে দিতে চাইছেন আপামর জনসাধারণের মধ্যে। যাতে এই মহামারীকে কাটিয়ে উঠে আমরা আবার জীবনের পথে এগিয়ে যেতে পারি, জীবনের জয়গান গাইতে পারি।
সংগঠকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তারা প্রতি দর্শনার্থীর হাতে মণ্ডপে প্রবেশের আগেই একটা করে ছোট স্যানিটাইজার পাউচ তুলে দেবেন। সেই সঙ্গে যারা মাস্ক বিহীন অবস্থায় থাকবেন তাদের প্রত্যেককে আলাদা করে মাস্ক তুলে দেয়া হবে। এই বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে কড়া নজরদারি চালানোর পরিকল্পনা করছেন তারা। রাজ্য সরকারের করোনা বিধি অনুযায়ী তাদের এবারের মন্ডপ তিনদিক খোলা হচ্ছে, তার ফলে রাস্তা থেকেই প্রতিমা দর্শন করা সম্ভব হবে। সেইসঙ্গে নিয়ন্ত্রণের জন্য কলকাতা পুলিশ নাকতলার দিকে চলাচল করা গণপরিবহনের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে জানা গিয়েছে। উদ্যোক্তাদের অনুরোধ শুধু সন্ধ্যা রাত্রিতে নয়, ঠাকুর দেখার জন্য ২৪ ঘন্টা সময়কেই যেন বেছে নেন দর্শনার্থীরা। তাতে ভিড় কখনোই খুব বেশি হবে না।
তবে শুধু দুর্গোৎসবে শামিল হওয়াই নয়, নানা সারা বছর জুড়ে নানা রকম সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে নাকতলা উদয়ন সংঘ দুর্গোৎসব কমিটি। এই করোনা অতিমারী এবং আম্ফান ঝড়ের পরবর্তী সময়েও তারা তাদের এই ভূমিকা বজায় রেখেছিল। এই সময় তারা দীর্ঘ চার মাস ধরে টালিগঞ্জ থেকে শুরু করে গড়িয়া হয়ে বাঘাযতীন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের মধ্যে যত ভিখারী ও ভবঘুরে ছিলেন তাদের প্রত্যেককে প্রতিদিন রান্না করা খাবার খাওয়ানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে স্থানীয় অঞ্চলের দুঃস্থ মানুষদের টানা দু’মাস জুড়ে চাল, ডাল, আলু সহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিনামূল্যে পৌঁছে দিয়েছেন। এলাকার করোনা আক্রান্ত পরিবারগুলোর হাতে বিনামূল্যে রান্না করা খাবার তুলে দিয়েছেন দুবেলা, যাতে তাদের জীবন যাপনে কোন অসুবিধা না হয়। একই সঙ্গে তারা নিশ্চিন্তে হোম আইসোলেশনে থাকতে পারে। আম্ফান এর পর নাকতলা উদয়নের সদস্যরা সুন্দরবনের রাঙাবেলিয়া ও দুলকি নামে এই দুটি গ্রামে গিয়ে সেখানকার বিপর্যস্ত অসহায় গ্রামবাসীদের দুই মাসের মত খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন। শুধু তাই নয়, দূর্গোৎসব উপলক্ষে রাঙাবেলিয়া ও দুলকির মানুষজনের জন্য নতুন জামা কাপড় পাঠিয়েছে নাকতলা উদয়ন। যথার্থই নাকতলা উদয়ন কেবল দুর্গোৎসব আয়োজনে নয়, তা যাতে সবার উৎসব হয়ে ওঠে সেই প্রচেষ্টায় নিমগ্ন থেকে এবারের নিউ নর্মাল দূর্গোৎসব আরাধনায় মেতে উঠেছে।