জাহাঙ্গীরের আমল থেকে চলছে পুজো, সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির বনেদিয়ানা হার মানায় থিমকেও

বাংলায় দুর্গাপুজোর ইতিহাস যে ঠিক কতটা পুরোনো তা নিয়ে কিছু মতভেদ আছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় মোটামুটি আঠারো- উনিশ শতকে গ্রাম বাংলার বিক্ষিপ্ত কিছু কিছু জায়গায় প্রচলিত ছিল এই পুজো। মূলত সাগর পাড়ের দেশ থেকে আসা সাদা চামড়ার সাহেবদের তোষামোদকারী কিছু বিত্তশালী জমিদারগণই সেসময় এই পুজোর আয়োজন করতেন। সাহেবদের জন্য আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থাও তাতে থাকত ভরপুর।
কিন্তু সাহেবদের আসার আগে বাংলায় কি দুর্গোৎসব ব্রাত্য ছিল? বস্তুত, বাংলা তথা ভারত ভূখন্ডে সাহেবদের পদার্পণের অনেক আগে থেকেই যে স্বমহিমায় দুর্গাপুজোর প্রচলন ছিল তারও প্রমাণ মেলে। সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো প্রচলিত ছিল সপ্তদশ শতকেও। বড়িশার জমিদার লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার, স্ত্রী ভগবতী দেবীর ইচ্ছেয় ১৬১০ সালে এই পুজোর সূচনা করেন। শোনা যায়, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে জায়গিরদারি লাভ করেছিলেন লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার। তারপরেই দুর্গাপুজো করার সিদ্ধান্ত নেন। তখনও কলকাতা শহরের পত্তন হয় নি। এমনকি শোনা যায়, স্বয়ং ঔরঙ্গজেবও নাকি উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের পুজোয়।অর্থাৎ, সেসময় সতেরো আঠারো শতকেও যে এই পুজোর জৌলুস জাঁকজমক কিছু কম ছিল না, তা সহজেই অনুমেয়।
সাবর্ণ রায় চৌধুরী বাড়ির পুজো মোট ৮টি বাড়িতে পূজিত হয়। লাল বা হালকা সোনালী রং-এর হয়ে থাকে প্রতিমার মুখ। অসুরের রং হয়ে থাকে সবুজ। বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী রীতি-নিয়ম মেনে ৮টি আলাদা আলাদা পুজো করা হয়। এই ৮টি পুজোর মধ্যে ৬টি পুজো হয় বড়িশাতে। সেই পুজোগুলি হল যথাক্রমে প্রথমটি আটচালা বাড়ি পুজো, দ্বিতীয়টি বড় বাড়ির পুজো, তৃতীয়টি বেনাকি বাড়ি পুজো, চতুর্থটি মেজো বাড়ি পুজো, পঞ্চমটি কালীকিঙ্কর ভবন পুজো, ষষ্টটি মাঝের বাড়ি পুজো। সপ্তম পুজোটি হয় বিরাটি-তে। বিরাটির এই পুজো বিরতি বাড়ির পুজো নামে পরিচিত। অষ্টম পুজটি হয় নিমতা-তে। নিমতা পাঠানপুর বাড়ির পুজো এই নামে জনপ্রিয়। উল্লেখ্য, প্রতিটি পুজোতেই দুর্গার এক দিকে থাকে রাম, অন্য দিকে শিবের মূর্তি। তবে বাহন সিংহের মুখাবয়ব ক্ষেত্রবিশেষে আলাদা।
এই বাড়ির পুজোর চালচিত্রে রয়েছে ছিন্নমস্তা, বগলা, মাতঙ্গী, কমলাকামিনী-সহ দশমহাবিদ্যা। আর এই দশমহাবিদ্যার সঙ্গে রয়েছেন রাধাকৃষ্ণ। আগে এই বাড়ির পুজোয় ১৩টি ছাগল ও ১ টি মোষ বলি হত। সাবর্ণ রায় চৌধুরী-র বাকি সমস্ত বাড়িগুলিতে আমিষ ভোগের আয়োজন করা হয়। কেবলমাত্র নিমতার বাড়িতে হয় সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোগ।
একুশ শতকের পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতায় থিম পুজোর বাড়বাড়ন্তের আঁচটুকুও লাগেনি যে সমস্ত সাবেকি পুজোয়, ৪১১ বছরের পুরনো সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো তাঁর মধ্যে অন্যতম। এই বনেদি বাড়ির পুজোয় এখনো যেন আটকা পড়ে আছে সতেরো শতকের প্রাচীন গ্রাম বাংলা।